নিজস্ব প্রতিবেদক :
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোয় অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকেই রয়েছে তিন লাখ ৩১ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৭১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। গত মার্চ শেষে এ ব্যাংকের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের ঋণ খেলাপি হওয়ায় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত ডিসেম্বরে এ ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা বা ৭২ শতাংশ।
ব্যাংক খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের। এ ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ব্যাংকটি হাসিনা সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকাকালীন নামে-বেনামে টাকা বের করে নেওয়া হয়। এসব ঋণ এখন খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে খেলাপি বাড়ছে। গত বছর শেষে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ছিল ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি বা ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ।
তৃতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ অগ্রণী ব্যাংকে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ২৭ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ খেলাপি ছিল। মার্চ শেষে তা বেড়ে ২৯ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বা ৪১ দশমিক ৩৫ শতাংশ খেলাপি হয়। চতুর্থ অবস্থানে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। মার্চ শেষে ব্যাংকটির ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশ খেলাপি। গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ছিল ২৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা।
শীর্ষ পাঁচে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের মার্চ শেষে খেলাপি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আওয়ামী লীগ আমলে এ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল সালমান এফ রহমানের কাছে। তার ক্ষমতাবলে ব্যাংক থেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। এসব ঋণ এখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ হঠাৎ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ছিল ১৭ হাজার ১৮২ কোটি বা ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরেকটি ছিল ইউনিয়ন ব্যাংক। এ ব্যাংক খেলাপি ঋণে শীর্ষ ছয়ে রয়েছে। মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৮৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ব্যাংকটির বেশিরভাগ ঋণের টাকা এস আলম গ্রুপ নিয়ে যায়। এর পরের অবস্থানে একই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। মার্চ শেষে এ ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৩৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এ ছাড়া খেলাপি ঋণে শীর্ষ আটে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। মার্চ শেষে এ ব্যাংকের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ১১ শতাংশে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৬ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। মার্চ শেষে ১৭ হাজার ১২৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে রূপালী ব্যাংকের, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে এ ব্যাংকের খেলাপি ছিল ১৫ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। তা ছাড়া শীর্ষ দশে থাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আবার ঋণখেলাপির নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণ খেলাপি করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরো বাড়তে পারে।
শীর্ষ ১০ ব্যাংক ছাড়াও অনেক ব্যাংকের খেলাপি বাড়ছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংকের মার্চ শেষে খেলাপি বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। এবি ব্যাংকের বেড়ে হয় ৮ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের আট হাজার ৬৪৬ কোটি, ইউসিবির আট হাজার ৬২৮ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাত হাজার ৭৯৮ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সাত হাজার ৯৪২ কোটি টাকা।